অতঃপর যুদ্ধ বিরতি ‘মনোয়ার হোসেন রতন’

প্রকাশিত: ৪:৪৮ অপরাহ্ণ, জুন ৪, ২০২১

অতঃপর যুদ্ধ বিরতি ‘মনোয়ার হোসেন রতন’

অতঃপর যুদ্ধ বিরতি
‘মনোয়ার হোসেন রতন’
‘যে নিজেকে পানি দিয়ে ভেজায়, সে কাপড় বদলায়। যে ঘাম দিয়ে ভেজায়,
সে ভাগ্য বদলায়।যে রক্ত দিয়ে ভেজায়,সে ইতিহাস বদলায় ।
‘ইবনুল আরাবী (রহঃ)
আন্তর্জাতিক ভূ-রাজনীতির ইতিহাস ভয়াবহ রক্তের ইতিহাস। বিগত সাড়ে পাঁচ হাজার বছরে পৃথিবীর মানুষ প্রত্যক্ষ করেছে সাড়ে চৌদ্দ হাজার যুদ্ধ, এছাড়াতো আরো দুটি বিশ^যুদ্ধতো রয়েছেই। এখনও বিশে^ যুদ্ধ, ধ্বংস, রক্ত প্রত্যক্ষ করে চলেছে পৃথিবীর মানুষ। মালয়েশিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী ড. মাহাথির মোহাম্মদ বলেছেন, পৃথিবীর সকল সন্ত্রাসের মূলেই হচ্ছে ইসরায়েল। ফিলিস্তিনিদের ভূমি দখল করে সেখানকার নব্বই ভাগ আরব জনগণকে উৎখাত করে ইসরায়েল নামক রাষ্ট্রের সৃষ্টি হচ্ছে আধুনিক সন্ত্রাসবাদের শুরু। ইসরায়েলকে থামাতে না পারলে দুনিয়াকে সন্ত্রাস মুক্ত করা যাবে না । মুসলিম বিশে^র জন্য তথা গোটা পৃথিবীর ক্ষত তৈরি হয়েছিল, ১৯১৭ সালে প্রথম বিশ^যুদ্ধে মিত্রবাহিনীকে বিজয়ী হতে সহযোগিতা করেছিলো ইহুদি বিজ্ঞানী ড. হেইস বাইজম্যান মারনাস্ত্র তৈরীতে অবদান রেখে। তারই পুরষ্কার স¦রুপ মিত্রপক্ষের প্রধান শক্তি ব্রিটেন মহাযুদ্ধ শেষে ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী আর্থার বেলফোর পার্লামেন্টে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার রুপরেখা দিয়ে ব্রিটিশ ম্যান্ডেড প্রদান করেন। যা ইতিহাসে বেলফোর ঘোষনা নামে পরিচিত। মূল প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল, ইহুদিদের জন্য একটি জাতি রাষ্ট্র গ্রহন। এভাবেই ফিলিস্তিনের একাংশে ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়। পৃথিবীর একমাত্র এ ইহুদি রাষ্ট্রের স্বপদ্রষ্টা হাঙ্গেরিতে জন্ম নেয়া সাংবাদিক, নাট্যকার, থিওডোর হার্জেল। ১৮৯৬ সালে তার প্রকাশিত গ্রন্থ উঊঅজ ঔটউঊঘঝঞঅঞঞ (ইহুদি রাষ্ট্র) এ তিনি স্বপ্নের কথা লিখেন। তাকে ইহুদিবাদের প্রবক্তাও বলা হয়ে থাকে।

মূলতঃ প্রথম বিশ^যুদ্ধের সময় ফিলিস্তিন ছিলো তুর্কি অটোমান সা¤্রাজের অংশ। এ অঞ্চলে আরবরাই বসবাস করতো। ব্রিটেন, যুক্তরাষ্ট্র ও সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন মিলে জাতিসংঘের মাধ্যমে ফিলিস্তিনের পচিঁশ শতাংশ এলাকায় ইহুদি রাষ্ট্র সৃষ্টি করে। ১৯৪৮ সালের ১৪ই মে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়। আজ এ ইহুদিরা আরব ফিলিস্তিনিদের নব্বই শতাংশ মাতৃভূমি দখল করে নিয়েছে। আবাস ভূমি থেকে বিতাড়িত ফিলিস্তিনিরা ত্রুমান্বয়ে সংঘবদ্ধ হয়ে মাতৃভূমি পুনরুদ্ধারের চিরস্থায়ী এক যুদ্ধে তৎপর হয়ে ওঠে। স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র ঘোষণা করা হয় ১৫ নভেম্বর ১৯৮৮ সালে। এখানে উল্লেখ্য যে, প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশনের আল ফাতাহ গ্রুপ গঠিত হয় ১০ অক্টোবর ১৯৫৯ সালে। ইয়াসির আরাফাত এর প্রধানের দায়িত্ব প্রাপ্ত হন ২ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯ সালে। হামাস ফিলিস্তিনের একটি রাজনৈতিক সংগঠন যা ১৪ নভেম্বর ১৯৮৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিষ্ঠিতা শেখ আহমদ ইয়াসিন অনেকে তাঁকে আবু অমর বলে সম্বোধন করতেন। বর্তমান সময়ে যে যুদ্ধ চলছে তাকে গোটা বিশ^ ইসরায়াল- হামাস যুদ্ধ বলেই চিহ্নিত করেছেন। ফিলিস্তিনি জনগণ অবরুদ্ধ থেকে মুক্তির আশায়, ইসরায়েলি আগ্রাসন থেকে নিরাপদ থাকবার জন্য যে মরণপণ লড়াই করে যাচ্ছে তাঁকে সমর্থন করছে বিশে^র কোটি কোটি মানুষ। মানুষ শান্তি চায়, শান্তির পক্ষে, মানুষ সহজাত ভাবে শান্তিকামী। সাধারণ মানুষ জানে যুদ্ধ মানেই সভ্যতার বিনাশ, যুদ্ধ মানেই মানুষের অস্তিত্বের অবসান। রাজনীতি মানুষের জন্য, মানবতার মুক্তির জন্য, ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য, জুলুম, অত্যাচার আর নির্যাতন এর হাত থেকে বাঁচার জন্যই রাজনীতি এবং প্রতিবাদ। ১৯৬৯ সালে ২১ আগষ্ট জেরুজালেমে অবস্থিত মুসলমানদের প্রথম কেবলা পবিত্র মসজিদ আল-আকসাতে ইসরায়েল কর্তৃক অগ্নি-সংযোগের প্রেক্ষিতে প্রতিবাদ স্বরুপ, স্বার্থরক্ষার স্বার্থে ২৫ সেপ্টেম্বর ১৯৬৯ সালে মরক্কোর রাজধানী রাবাতে ইসলামী সম্মেলন সংস্থা অথাৎ ওআইসি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো, যার বর্তমান সদস্য সংখ্যা ৫৭ টি। এ ৫৭ টি মুসলিম বিশে^র নেতাদের তনু মন প্রাণ এখনও একই সুরে বেজে উঠছেনা, ফিলিস্তিনি জনগণ তথা পবিত্র ভুমি রক্ষার স্বার্থে। কারন তাদের নিজেদের চরিত্র হচ্ছে, আধিপত্যবাদ, সা¤্রাজ্যবাদ এবং উপনিবেশবাদী রাষ্ট্রগুলোর তল্পিবাহক হিসেবে আজ তারা কাজ করছেন। আজ দেশে দেশে রাজনীতির চরিত্র বদল হয়ে গেছে, পৃথিবীব্যাপি যুদ্ধবাজ ব্যবসায়িক নেতাদের অতিলোভের কারণেই প্রতিনিয়ত তৈরী হচ্ছে হা হা কার, অভাব, অস্থিরতা। তারা বলতে পারছেনা আর যুদ্ধ নয়, আর নয় মায়েদের শিশুদের কান্না, রক্ত কি, ধ্বংস কি, যুদ্ধ আর না আর না।

ইতোমধ্যে ইসরায়েল- ফিলিস্তিন যুদ্ধ বিরতি ঘোষণা করা হয়েছে। এ যাবত কালে বিশ^ নেতাদের আহব্বানে যুদ্ধ বিরতি, শান্তির আহব্বানের প্রস্তাব করা হয়েছে বহুবার। কিন্তু শান্ত হয়েছে কি বিশ^, কিংবা ইসরায়েল – ফিলিস্তিন? তেমন একটা আমরা দেখতে পাইনা। আমরা পাই দুষ্টু চরিত্রের বিশ^নেতা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধ বিরতির প্রস্তাব দিয়েছিলেন অথচ তার পাশাপাশি একই সময়ে ইসরায়েলে অত্যাধুনিক অস্ত্র বিক্রির অনুমোদনও দিয়েছেন বাইডেন প্রশাসন । আন্তর্জাতিক ঘৃন্য রাজনীতি আমরা প্রত্যক্ষ করছি। অতীতেও দেখেছি, বর্তমানেও দেখছি, আমেরিকার ইরাক আক্রমণ, লিবিয়া, লেবানন, সিরিয়াসহ গোটা বিশে^ যুদ্ধবাজ নেতাদের তেল-জল-খনিজ সম্পদের ভাগাভাগি। আমরা স্পষ্টতঃ চাই, ফিলিস্তিনের জনগনের চিরস্থায়ী মুক্তি, শান্তি, মাতৃভূমির অধিকার। জাতিসংঘ সনদের যথাযথ মূল্যায়ন। যেখানে বলা হয়েছে, মানুষ’ রাষ্ট্র নয়। ফিলিস্তিনভূমি থেকে চিরতরে মানুষের আর্তনাদ, চিৎকার কান্নার ধ্বনি, হত্যা বন্ধ হউক। আমরা দেখতে চাই না, ক দিন পর পর যুদ্ধ বিরতি ঘোষনা তারপর ইসরায়লির বৃদ্ধাঙ্গুুলি। এরই মধ্যে যুদ্ধ বিরতি ঘোষণার মধ্যে আবার উত্তেজনা এবং দাঙ্গার খবর পাওয়া যাচ্ছে। ইসরায়েল মূলতঃ মানুষ মারছে না, ওরা আরব মারছে, ওরা মুসলমান মারছে। তাদের সন্ত্রাসী নেতারা মনে করেন, মুসলমান এবং আরবরা মানুষ না। মানবতার কথা, মানবিক রাষ্ট্রের কথা ইসরায়েলি নীতি নির্ধারকগণ এবং তাদের দোসররা এটা তারা জানেনইনা। তারা ভাবেন, আন্তর্জাতিক রাজনীতি নিয়ে, আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে স্থায়ীবন্ধু বা শক্র বলে কিছু নেই, আছে চিরস্থায়ী জাতিয় স্বার্থ। স্যামুয়েল পি.হান্টিংটন তাঁর সভ্যতা সমূহের মধ্যকার দ্বন্দ্ব বা দি ক্লেশ অব সিভিলাইজেন এ দেখিয়েছেন, নতুন বিশ^ ব্যবস্থায় ষ্ট্যাট টু ষ্ট্যাট যুদ্ধ না হয়ে এবং সভ্যতার মধ্যকার ভাষা, গোত্র, ধর্ম, সংস্কৃতি জাতিগত দ্বন্দ্ব থেকে সংঘাত সৃষ্টি হবে। এ ধারনা থেকে তিনি পৃথিবীকে নয়টি বলয় বা শ্রেনীতে ভাগ করেছেন। যেমন, *পশ্চিম *ল্যাটিন *আমেরিকান * আফ্রিকান * ইসলামী *চীনা *হিন্দু *গোড়া মৌলবাদী *বৌদ্ধ *জাপানী। বর্তমানে কি আমরা তাই প্রত্যক্ষ করছি না?

একদিন শান্তিকামী মানুষের উদ্যোগে গড়ে উঠেছিলো জাতিসংঘ। একদিন পাবলো পিকাসো লিথোগ্রাফে শান্তির প্রতীক সাদা পায়রার ছবি এঁকে বদলে দিয়েছিলো গোটা বিশ^কে। আন্তর্জাতিক অপরাজনীতি নিপাতের মধ্যদিয়ে একদিন ফিলিস্তিনিদের আসন্ন মুক্তি দিক চক্রপাল স্পষ্ট হয়ে উঠবেই। কোন এক মহামানবের আর্বিভাবের মধ্য দিয়ে, অতঃপর চিরস্থায়ী এ যুদ্ধ, বিরতির মধ্য দিয়েই একদিন প্রকৃত বিজয়ের মাধ্যমে ফিলিস্তিনি জনগণ তাঁদের মাতৃভূমি প্রতিষ্ঠা করবেই….

Please follow and like us:

ফেইসবুকে আমরা

সর্বশেষ সংবাদ