বরফের দেশ সিকিমে…

প্রকাশিত: ১:০৮ অপরাহ্ণ, মার্চ ১০, ২০১৯

বরফের দেশ সিকিমে…

ভ্রমণপ্রেমীদের কাছে বিশ্বের যে কয়টা স্থান ভালো লাগার কাতারে আছে, তার মধ্যে একটি সিকিম। চীন, নেপাল ও ভুটান সীমান্তে উঁচু পাহাড়ঘেরা এই রাজ্যের বেশ কিছু এলাকা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১৭ হাজার ফুটের বেশি উঁচুতে। এসব উঁচু পাহাড়গুলো বছরের অধিকাংশ সময় বরফে ঢাকা থাকে। যেদিকে চোখ যায় শুধু বরফ আর বরফ। মনে হয় কোনো এক বরফ দেশে গেছেন। এসব বরফ ও পর্বত দেখতে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে লাখ লাখ পর্যটক ছুটে এলেও বাংলাদেশিদের ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা থাকায় এসব দর্শনীয় স্থানগুলো ছিল শুধু কল্পনা।

গত ২০ নভেম্বর এসব স্থানগুলো বাংলাদেশিদের জন্য খুলে দেওয়া হয়। ওই দিন তৎকালীন ভারতীয় হাইকমিশনার হর্ষ বর্ধন শ্রিংলা ঢাকার নিজ কার্যালয়ে সংবাদ ব্রিফিংয়ে সিকিম উন্মুক্তের ঘোষণা দেন। একই সঙ্গে খুলে দেওয়া হয় অরুণাচল ও কাশ্মীরের লাদাখ। তারপর থেকে বাংলাদেশের পর্যটক ও ভ্রমণপ্রেমীরা ঘুরতে পাড়ি জমাচ্ছেন অনিন্দ্যসুন্দর সিকিমে।

শুধু বরফ নয়, বিশাল পাহাড়ের ঢালে বসতি আঁকাবাঁকা সড়ক যেতে চোখে পড়বে অসংখ্য ঝরনা। ৫ থেকে ১০ হাজার ফুট ওপরে পাহাড়ের কোমরে তৈরি করা সড়কে যেতে আপনার গা ছমছম করবে। এ ছাড়া পাহাড়ি সড়কে কখনো বামে কখনো ডানে আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিত তিস্তা নদীর দেখা মিলবে। হিমালয়ের হিমবাহ থেকে সৃষ্টি হওয়া সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২৩ হাজার ফুট ওপরে তিস্তা নদী প্রায় ১৭০ কিলোমিটারজুড়ে সিকিম রাজ্যে বয়ে চলেছে। এসব পানি পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিং, জলপাইগুড়ি হয়ে বাংলাদেশে আসে।

সিকিমের রাজধানী পর্যটনের সংশ্লিষ্টরা জানান, গত বছরের ডিসেম্বরের মাঝামাঝি থেকে দেশি-বিদেশি পর্যটকদের সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের পর্যটকেরাও আসতে থাকেন। সম্প্রতি বাংলাদেশি পর্যটকের সংখ্যা আরও বাড়ছে। সিকিমে যাওয়ার আগে প্রথম গ্যাংটকে অবস্থান করতে হয়। সেখান থেকে বিভিন্ন দর্শনীয় স্থানে যেতে হয়। এর মধ্যে উত্তর সিকিমের লাচুংয়ের ছাঙ্গু লেক, কাটাও, নাথুলা, ইয়ামথাং ভ্যালি বা জিরো পয়েন্ট ও গুরুদোকমার লেক রয়েছে।

সিকিমে এমন সব এলাকা আছে যেগুলো বছরের অধিকাংশ সময় এভাবে বরফে ঢেকে থাকে। ছবি: লেখক

গত ১৪ ফেব্রুয়ারি সাত ঘণ্টা যাত্রা শেষে সিকিমের রাজধানী গ্যাংটকের হোটেল পাইন লিফে উঠলাম। কিছুক্ষণ পর জানতে পারি আমাদের যেসব স্থানে যাওয়ার কথা ছিল (ছাঙ্গু লেক, গুরুদোকমার লেক ও জিরো পয়েন্ট) বরফ পড়ায় সেসবের সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছে। পরদিন সকালে উত্তর সিকিমের সবচেয়ে দূরের লাচুং গ্রামের উদ্দেশে রওনা দিলাম। সন্ধ্যায় লাচুং গ্রামে পৌঁছালাম। চারদিকে বরফেঘেরা এ গ্রামের তাপমাত্রা তখন জিরো ডিগ্রি সেলসিয়াস। এরপর সকালে ইয়ামথাং উপত্যকার উদ্দেশে রওনা দিলাম। ঘণ্টা দুয়েক পথ যাওয়ার পর আমাদের গাড়ির চালক বিকাশ লিম্বো বলেন, স্যার, আর যাওয়া যাবে না। গাড়ি থেকে নেমে দেখলাম সড়কজুড়ে বরফ আর বরফ। দু-এক ঘণ্টা সেখানে বরফ নিয়ে খেললাম। পরে গ্যাংটক ফিরে আসি। তখন এসে জানতে পারলাম ছাঙ্গু লেক খুলে দেওয়া হয়েছে। সড়কে জমে থাকা বরফ সরানো হয়েছে। সকাল ৯টার দিকে রওনা দিলে দেড় ঘণ্টার মধ্যে ছাঙ্গু লেকে পৌঁছায় আমাদের গাড়ি। গাড়ি থেকে নেমে দেখি অসংখ্য পর্যটক। কেউ ইয়াকের (তিব্বতি গরু) পিঠে ছড়ছে, কেউ কেবল কার আবার কেউ বরফ নিয়ে খেলছে। বরফে আচ্ছাদিত এলাকায় ঢোকার আগে নির্দিষ্ট পয়েন্টে জ্যাকেট, জুতা ও দস্তানা ভাড়ায় পাওয়া যায়।

বাংলাদেশের পর্যটক নোয়াখালী জেলার গৌতম সেন, মুন্সিগঞ্জের বাচ্চু দাশ ও রাঙামাটির দীপ্ত দেওয়ান বলেন, আমরা বরফ দেখতে এসেছি। এখানে এসে স্বর্গে এসেছি বলে মনে হচ্ছে। এত সুন্দর জায়গা জীবনে দেখিনি। এখানে এসে আমাদের বাংলাদেশ থেকে অনেক পরিচিত মানুষের সঙ্গে দেখা হয়েছে। অনেক দিন ধরে ইচ্ছা ছিল জীবনে একবার হলেও সিকিমে বরফ দেখতে যাব।

গ্যাংটক শহরে হোটেল পাইন লিফের ব্যবস্থাপক রাজেশ দাশ গুপ্ত বলেন, সিকিমে সারা বছর পর্যটক থাকেন। তবে নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বরফে সড়ক ঢাকা পড়ায় দর্শনীয় স্থানের সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। এতে পর্যটক একটু কম আসেন। মে, জুন ও জুলাই মাসে সিকিমে পর্যটকদের ভরা মৌসুম। বিভিন্ন দেশ থেকে যেসব পর্যটক আসেন সবাই গ্যাংটক শহরের অবস্থান করেন। শুধু গ্যাংটক শহরে সাত থেকে আট লাখ পর্যটক থাকার ব্যবস্থা রয়েছে। তবে ভরা মৌসুমে গ্যাংটকে সচরাচর গাড়ি ও হোটেল পাওয়া যায় না। ভাড়াও দ্বিগুণ বেড়ে যায়।

দক্ষিণ সিকিমের ছাঙ্গু লেকের ব্যবসায়ী সুস্মা তামাং বলেন, ডিসেম্বর, জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে বরফে প্রায় সময় রাস্তা বন্ধ ছিল। সে জন্য পর্যটকও তেমন আসেনি। দুই দিন ধরে ছাঙ্গু লেক খুলে দেওয়া হয়েছে। এখন প্রতিদিন হাজার হাজার পর্যটক আসছেন। অন্য সময় বাংলাদেশিরা আসতে না পারলেও ছাঙ্গু লেকে সম্প্রতি অনেক বাংলাদেশি দেখা যাচ্ছে।

ঘুরতে এসে বরফের সঙ্গে স্মৃতি ফ্রেমবন্দী করা হবে না—তা কি হয়! ছবি: লেখক

গ্যাংটক থেকে উত্তর ও দক্ষিণ সিকিমের গাড়িচালক বিকাশ লিম্বো বলেন, গ্যাংটক থেকে সিকিমে পর্যটকদের আসা-যাওয়ার জন্য কয়েক হাজার গাড়ি রয়েছে। তারপরও গাড়ির সংকুলান হয় না। গত কয়েক মাসের তুলনায় পর্যটকের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। এখানে পাথরের পাহাড়, কোনো কিছুর চাষ হয় না। শুধু পর্যটনের ওপর মানুষের আয়।

সিকিমে পর্যটকদের দর্শনীয় স্থানগুলোর উচ্চতা
উত্তর সিকিমের গুরুদোকমার লেক সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১৭ হাজার ৮০০ ফুট, একই এলাকায় জিরো পয়েন্ট ১৫ হাজার ৫০৩ ফুট, ইয়ামথাং উপত্যকা ১১ হাজার ৮০০ ফুট, কাটাও ১৫ হাজার ফুট, নাথুলা ১৪ হাজার ১৪০ ফুট ও দক্ষিণ সিমিকের ছাঙ্গু লেকের উচ্চতা ১২ হাজার ৩১৩ ফুট। পর্যটকদের জন্য এসব দর্শনীয় স্থানে ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি মাসে অধিকাংশ সময় বন্ধ থাকে। এসব স্থানে যাওয়ার সড়কে ১ থেকে আড়াই ফুট পর্যন্ত বরফ জমে যোগাযোগে বিঘ্ন ঘটায়।

সিকিম কীভাবে যাবেন
পঞ্চগড়ের বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর ইমিগ্রেশনের কাজ শেষ করে শিলিগুড়ি যাবেন। শিলিগুড়ি থেকে গ্যাংটকের দূরত্ব ১১৪ কিলোমিটার। আঁকাবাঁকা পাহাড়ি সড়ক যেতে লাগবে অন্তত সাড়ে পাঁচ ঘণ্টা। চুমো বা অন্য গাড়ি নিলে আপনার কাছে গ্যাংটক পর্যন্ত ৩ হাজার টাকা নেবে। গ্যাংটক শহরে হাজারো হোটেল-মোটেল আছে। হোটেলের ভাড়া দুই বেডের দেড় হাজার থেকে ৫ হাজার টাকা। তবে পর্যটকদের ভরা মৌসুমে এ ভাড়া দ্বিগুণ হয়ে যায়। গ্যাংটক শহর থেকে ১১৬ কিলোমিটার রাস্তা লাচুং গাড়িভাড়া ৩ হাজার। লাচুং গ্রামে রাতযাপন করে কাটাও কিংবা ইয়ামথাং উপত্যকা-জিরো পয়েন্ট ঘুরে আবার গ্যাংটকে নিয়ে আসবে ওই ৩ হাজার টাকা ভাড়ার মধ্যে। গুরুদোকমার লেক ও নাথুলা যাওয়ার ভাড়া ২ থেকে ৩ হাজার করে নেবে।

 

:: সাধন বিকাশ চাকমা, সিকিম থেকে ফিরে

Please follow and like us:

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ

ফেইসবুকে আমরা

সর্বশেষ সংবাদ